জলবায়ু সহনশীল ফসল: বন্যা ও লবণাক্ততা মোকাবিলার উপায়

 

জলবায়ু সহনশীল ফসল: বন্যা ও লবণাক্ততা মোকাবিলার উপায়

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় প্রতি বছর বন্যা, লবণাক্ততা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কৃষকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তবে সঠিক ফসল নির্বাচন ও আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করে এসব সমস্যা মোকাবিলা সম্ভব। এই নিবন্ধে আমরা জানবো কীভাবে বন্যাসহিষ্ণু ও লবণাক্ততা সহনশীল ফসল চাষ করে কৃষকরা তাদের উৎপাদন বাড়াতে পারবেন।


বাংলাদেশে জলবায়ু সংকটের প্রভাব

বাংলাদেশের ২০% এলাকা প্রতিবছর বন্যায় আক্রান্ত হয়, আর উপকূলীয় অঞ্চলের ৩০% জমি লবণাক্ততার শিকার। এর ফলে ধান, গম ও সবজির উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

  • উদাহরণ: কুড়িগ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম গত বছর বন্যায় তার ২ একর ধান ক্ষেত হারিয়েছেন।

  • সমাধানের পথ: জলবায়ু সহনশীল ফসল চাষ (যেমন: ব্রি ধান ৫২, সূর্যমুখী)।


বন্যা প্রবণ এলাকার জন্য সেরা ৫টি ফসল

ক) ব্রি ধান ৫২ (বন্যাসহিষ্ণু ধান)

বন্যাসহিষ্ণু ধান ক্ষেত: ব্রি ধান ৫২ জলমগ্ন অবস্থায় চাষ (কুড়িগ্রাম)
ধান  চাষ


  • বৈশিষ্ট্য: ১৫-২০ দিন পানির নিচে থাকলেও বেঁচে থাকতে পারে।

  • উৎপাদন সময়: ১৪০-১৪৫ দিন।

  • উপজেলা: গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ।

  • বীজ সংগ্রহ: বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) থেকে।

খ) স্বর্ণ সুব-১

  • বন্যায় ১০-১২ দিন টিকে থাকতে পারে।

  • ফলন: হেক্টর প্রতি ৪-৫ টন।

গ) ডিপওয়াটার আমন ধান

  • হাওর অঞ্চলের জন্য উপযোগী (যেমন: সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ)।

  • বিশেষত্ব: লম্বা কাণ্ড (৩-৪ মিটার), যা বন্যার পানিতে ভাসে।

ঘ) ভুট্টা

  • বন্যাসহিষ্ণু হাইব্রিড জাত: বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১২

  • চাষ পদ্ধতি: উঁচু বেডে বপন করুন।

ঙ) কলমি শাক

  • দ্রুত বৃদ্ধি (২০-২৫ দিনে কাটার উপযোগী)।

  • পুষ্টিগুণ: আয়রন ও ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ।


 লবণাক্ত জমির জন্য আদর্শ ফসল

ক) ব্রি ধান ৪৭ (লবণাক্ততা সহনশীল ধান)

  • যেখানে চাষ করবেন: সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট।

  • লবণ সহন ক্ষমতা: ৮-১০ ডিএস/মি (মৃদু লবণাক্ততা)।

  • ফলন: হেক্টর প্রতি ৪.৫-৫ টন।

খ) তিল

  • লবণাক্ত মাটিতে চাষের জন্য উপযুক্ত।

  • জাত: বিনা তিল-৪, বারি তিল-৩।

  • বাজার মূল্য: ১০০-১২০ টাকা/কেজি।

গ) সূর্যমুখী

সাতক্ষীরায় লবণাক্ত জমিতে সূর্যমুখী চাষ: জলবায়ু সহনশীল ফসলের উদাহরণ


  • উপকারিতা: তেলের চাহিদা মেটানো + মাটির লবণ কমাতে সাহায্য করে।

  • চাষ পদ্ধতি: ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে বপন করুন।


 সরকারি সহযোগিতা ও প্রযুক্তি

  • বিনামূল্যে বীজ বিতরণ: ব্রি ও বারি থেকে লবণাসহিষ্ণু ধান ও তেলবীজের বীজ পাওয়া যায়।

  • প্রশিক্ষণ: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) এর মাঠ কর্মীরা লবণাক্ত জমির ম্যাপিং করে কৃষকদের পরামর্শ দেন।

  • অনলাইন সহায়তা: এগ্রোওয়েদার অ্যাপে আপনার এলাকার বন্যার পূর্বাভাস পেতে পারেন।


কৃষকের সাফল্যের গল্প

বাগেরহাটের কৃষক মো. হাবিবুর রহমান ২০২২ সালে ব্রি ধান ৪৭ চাষ করে ১ একরে ২২ মণ ধান পেয়েছেন। তার পরামর্শ:

"লবণাক্ত জমিতে ধান চাষ করতে চাইলে জমিতে পলি মাটির প্রলেপ দিন এবং সঠিক সময়ে বপন করুন।"


 বন্যা ও লবণাক্ত জমি ব্যবস্থাপনার টিপস

১. বন্যাপ্রবণ এলাকায়:

  • উঁচু বেড তৈরি করুন (১-২ ফুট উঁচু)।

  • দ্রুত ফলন দেওয়া ফসল (যেমন: কলমি শাক) চাষ করুন।

২. লবণাক্ত এলাকায়:

  • বর্ষার শুরুতে জমিতে স্বাদু পানি জমিয়ে ২-৩ দিন রেখে লবণ ধুয়ে ফেলুন।

  • জৈব সার (কম্পোস্ট, সবুজ সার) ব্যবহার করুন।


প্রায়ই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)

Q: লবণাক্ত জমিতে কি ধান চাষ সম্ভব?
A: হ্যাঁ, ব্রি ধান ৪৭ বা ব্রি ধান ৫৪ জাত ব্যবহার করুন।

Q: বন্যার পানি নামার পর কী করব?
A: দ্রুত ক্ষেত শুকিয়ে স্বল্পমেয়াদী সবজি (লালশাক, পুঁইশাক) চাষ শুরু করুন।


 উপসংহার

জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুগে বন্যা ও লবণাক্ততা মোকাবিলা করতে বিজ্ঞানভিত্তিক ফসল নির্বাচন এবং সরকারি সহযোগিতা কাজে লাগানো জরুরি। সঠিক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশের কৃষকরা তাদের উৎপাদন দ্বিগুণ করতে সক্ষম হবেন।




পরবর্তী নিবন্ধের বিষয়"ড্রিপ সেচ পদ্ধতি: পানির সাশ্রয় ও ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি" নিয়ে বিস্তারিত জানুন।


এই নিবন্ধটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গাইডলাইন, ব্রি-এর গবেষণা পেপার এবং বাংলাদেশের কৃষকের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। বিস্তারিত তথ্যের জন্য ব্রি ওয়েবসাইট ভিজিট করুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url